কেজিএফ ২: নিংড়ে নেওয়া সোনা যেন বদলা নিচ্ছে! কোলারের ধ্বংসের ইতিহাস

কেজিএফ ২: নিংড়ে নেওয়া সোনা যেন বদলা নিচ্ছে! কোলারের ধ্বংসের ইতিহাস

কেজিএফ ২: নিংড়ে নেওয়া সোনা যেন বদলা নিচ্ছে! কোলারের ধ্বংসের ইতিহাস
কেজিএফ ২: নিংড়ে নেওয়া সোনা যেন বদলা নিচ্ছে! কোলারের ধ্বংসের ইতিহাস

বিনোদন ডেস্ক : যেন আর এক হীরক রাজার দেশ! হাতে সোনা অথচ পকেট ফাঁকা।কোলারের মাটির নীচে নেমে যাঁরা সোনা তুলে আনতেন, তাঁরা কী ভাবে বেঁচে আছেন, কোনও দিনই তার খোঁজ নেননি খনির মালিকেরা। ঠিক যেমন আজও তাঁদের নিয়ে একইরকম উদাসীন সরকার। খনি না থাকলেও খননের বিষ থেকে গিয়েছে কোলার শহর জুড়ে।

নিরুপায় মানুষগুলো সেই বিষের সঙ্গেই ঘর করছেন ‘ভুতুরে শহর’ কোলারে। কাজ হারানোর ২১ বছর পরও সরকার তাঁদের বিকল্প কর্মসংস্থান করেনি। এমনকি পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করেনি।কোলারের ঘরে ঘরে এখন ক্যানসারের রোগী। এককালে খনির বিষাক্ত পরিবেশে সায়ানাইডের মতো ভয়ঙ্কর রাসায়নিক নিয়ে কাজ করেছেন সোনার খনির মজদুরেরা।

এই রোগ তারই দাম। তার পরও চিকিৎসার সুযোগ নেই। কারণ হাসপাতালই আর নেই কোলার শহরে। ১০০ কিলোমিটার দূরে বেঙ্গালুরুতে আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করানোর টাকা কোথায়? সোনার খনির মজুর হয়েও আজ হাতে কানাকড়ি নেই কেজিএফের শ্রমিকদের।আগেও শ্রমিকরা নামমাত্র অর্থই পেতেন। তবে কেজিএফের উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা তাদের জন্য অবারিত ছিল।

২০০১ সালে যখন সরকারি সংস্থা ভারত গোল্ড মাইন লিমিটেড এবং ভারত আর্থ মুভারস লিমিটেড কেজিএফকে পুরোপুরি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল, তার পরই একে একে বন্ধ হতে শুরু করল ক্লাব হাউস, কলেজ, স্কুল, হাসপাতালের মতো পরিষেবা।স্থানীয়দের কথায় যখন কোলারের ‘শান’ ছিল, তখন আলো নিভত না কেজিএফে। জল ছিল অপ্রতুল। কোলারের ‘মিনি ইংল্যান্ড’ ঝলমলাত দিনরাত। অথচ সেই কোলারেই এখন বিদ্যুতের জন্য নিত্য হাহাকার। স্বাস্থ্যকর পানীয় জলটুকু পান না মানুষ।

সোনা ফুরোতেই প্রয়োজন ফুরিয়েছে। চমক হারিয়ে এখন মলিন কেজিএফ।কিন্তু কী ভাবে গৌরব হারাল ভারতের ‘মিনি ইংল্যন্ড’? ১৮৭৫ সাল থেকে খনন শুরু হয় কেজিএফে। তার পর থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সোনা তুলেছে ব্রিটিশ সংস্থা। সেই সময়েই কেজিএফের সোনার উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছিল।প্রথমে মাটির এক কিলোমিটার নীচেই সেনার খোঁজ পাওয়া যেত। ক্রমে সোনার খোঁজে আরও গভীরে যাওয়া শুরু হল। প্রথমে দু’কিলোমিটার।

তার পর তিন কিলোমিটার। এশিয়ার আর কোথাও এত গভীরে সোনা খননের কাজ হয়নি।তবু সুফল মিলছিল না। প্রতি টন আকরিকে সোনার পরিমাণ কমতে শুরু করেছিল। এক কালে যেখানে এক টন আকরিক থেকে অন্তত ৪৫ গ্রাম সোনা পাওয়া যেত, সেখানে প্রতি টনে তিন গ্রাম করে সোনা পাচ্ছিল খননকারী সংস্থাগুলি। খরচে পোষাচ্ছিল না তাদের।তত দিনে কেজিএফে খননের কাজ শুরু করেছে ভারত সরকার। ১৯৭২ সালে কেজিএফের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারত গোল্ড মাইন লিমিটেড।

কিন্তু কেজিএফে প্রাপ্ত সোনার দামের থেকে তার জন্য করা খরচ ক্রমেই বাড়ছিল।অথচ কেজিএফে সোনা রয়েছে তখনও। অনাবশ্যক খরচ কমাতে সরকার বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নীরিক্ষা চালায় কেজিএফে। ১৯৬০ এবং ১৯৯২ সালে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করা হয়।এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক হোমি ভাবার করা একটি পরীক্ষাও ছিল। যেখানে আকরিককে সহজে গলিয়ে সোনা পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষাটি ব্যর্থ হয়।

 এরপরেও কেজিএফ থেকে সোনা তেলার কাজ চলছিল। কিন্তু বাধ্য হয়েই ২০০১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বন্ধ হয় কেজিএফ বন্ধ করে দেয় ভারত গোল্ড মাইন।তবু কোলার একটি সম্পন্ন শহর হিসেবেই থেকে যেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। কারণ খনি বন্ধ করার যে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, তা মানা হয়নি কেজিএফের ক্ষেত্রে।সাধারণত খনি এলাকায় রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহারের জন্য এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হয়।

তাই কেন্দ্রের নতুন নিয়ম অনুযায়ী যখনই কোনও খনি বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় এলাকাটির পরিবেশকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়। যা কোলারে কখনওই হয়নি।সরকারের এই উদাসীনতারই ফল কোলারের বিষ পাহাড়। দুর্ভাগ্যের বিষয় কোলারকে বাঁচাতে কোনও ‘উদয়ন পণ্ডিত’ আসেনি। ফলে বিষ পাহাড় রোজ কুড়ে কুড়ে শেষ করছে কেজিএফকে।গত ১২৬ বছর ধরে খননের কাজের যে বর্জ্য দিনের পর দিন জমা হয়েছিল কেজিএফে, তা থেকে তৈরি হয়ছিল ওই বিশাল পাহাড়।

কোলারের পরিবেশ এবং মানুষের কাছে এই বিষের পাহাড়ই এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, এই পাহাড়ের বর্জ্যে মিশে রয়েছে সায়ানাইডের মতো রাসায়নিক। যা থেকে হাওয়ায় উড়ে আসা ধুলো প্রতি মুহূর্তে ঢুকছে কোলারের মানুষের শরীরে। স্থানীয়দের দাবি তা থেকে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন কোলারের বাসিন্দারা।বৃষ্টি হলে পাহাড় ধোয়া জল গড়িয়ে মেশে জলাজমিতে। মেশে কৃষিজমিতেও। তাতে বিষাক্ত হচ্ছে জল, মাটি।

কোলারের শ্রমিক বসতির যাঁরা কৃষিকাজ করেন, তাঁরা বলছেন এই বিষ জমিকে অনুর্বর করে তুলছে ক্রমশ। কমছে ফলন। বাড়ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের অসুস্থতা।সোনার খনির মজুররা তাঁদের এই দূরাবস্থার জন্য দায়ী করছেন সরকারকেই। তারা জানাচ্ছেন, বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও খনির শ্রমিকদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি সরকার। তাদের কাজের ব্যবস্থা করেনি। পরিবেশ দূষণ আটকানোর ব্যবস্থা করেনি। শহরটাকে ভুতুরে হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে আসলে কাজ করেছে কিছু মানুষের চূড়ান্ত অবহেলা আর উদাসীনতা।

সোনার খনির শ্রমিকরাই এখন কোলারের একমাত্র বাসিন্দা। তবে তাঁদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। মোট ৪০০টি শ্রমিক কলোনি মিলিয়ে কম করে আড়াই লক্ষ মানুষ বাস করেন কেজিএফে। এঁদের কারও কোনও নির্দিষ্ট কাজ নেই। ঠিকে কাজ করতেও ১০০ কিলোমিটার দূরে বেঙ্গালুরু যেতে হয়। ট্রেনে রোজ চার ঘণ্টার সফর। ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাতে ঘরে ফেরেন তাঁরা। তবে এ ভাবে কত দিন চলবে, তা জানা নেই তাঁদের।সে দিনের সোনার শহর আজ মৃতপ্রায়।

কোলারের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য বহু প্রস্তাব জমা পড়েছে সরকারের কাছে। পর্যটনের জন্য কেজিএফকে নতুন করে সাজানোর কথা বলা হয়েছে। প্রাসাদোপম বাংলোগুলো সারিয়ে হোম স্টের প্রস্তাবও রয়েছে।কিন্তু সে সবই আপাতত প্রস্তাবের আকারেই রয়ে গিয়েছে। সরকারি লাল ফিতে পেরিয়ে আলোর মুখ দেখেনি। আর দিন দিন অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়া সোনার শহর।

মতিহার বার্তা / এম টি

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply